প্রতিদিনের মত মোড়ের এই টং দোকানটার কাছে এসেই আমার মেজাজ গরম হয়ে যায়। বদমাইশ
ছেলেগুলো রোজ একই টাইমে এখানে বসে থাকবে। ফেল ফেল করে তাকিয়ে থাকবে আর
মিট-মিট করে হাসবে। দেখে মনে হয় জীবনে কোন মেয়ে মানুষ দেখে নাই। যেন
ভিনগ্রহের কোন প্রাণী রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছে। ইচ্ছে করে প্রত্যেকটার দুই
গালে দুটি করে থাপ্পড় দিয়ে জিজ্ঞেস করি. তোদের খেয়ে-দেয়ে কাজ নাই?
প্রতিদিন এক-ই টাইমে এখানে বসে থাকিস কেন? আমাকে কি এলিয়েন মনে হয়?
কিন্তু পারছিনা। প্রতিদিনের মতো আজও দেখেও না দেখার মতো চলে যাচ্ছি।
আজ এমনিতেই মেজাজ গরম। দশ মিনিট দরে দাড়িয়ে থেকেও কোন রিক্সা না পেয়ে
হেটে কলেজে যাচ্ছি। রিক্সা ওয়ালারা মনে হচ্ছে আজ কাল প্রাইভেট কার ওয়ালা
হয়ে গেছে। এখন তারা রিক্সা চালায় না প্রাইভেট কার চালায়।
---এক্সকিউজ মি আপু।
আমি পিছন ফিরে তাকালাম। টং দোকানের ঐ বদমাইশ গুলোর একটি পিছনে দাড়িয়ে।
---আপু আপনার সাথে আমার একটু কথা ছিলো।
মাথায় এলোমেলো চুল। দেখে মনে হচ্ছে গত দুই সপ্তাহ ধরে মুখের দাড়ি কাটে না।
---কি কথা?
মুখ থেকে একটু আগে খেয়ে আসা সিগারেটের ধোঁয়া বেড়িয়ে আসছে। কপালে ফুটা
ফুটা ঘাম। মনে হচ্ছে এই মাত্র দুই মন ওজনের বস্তা নামিয়ে এসেছে মালিকের
কাছ থেকে টাকা নেয়ার জন্য।
---আসলে আপু কিভাবে কথাটা বলবো বুঝতে পারছিনা।
---বুঝতে পারছেন না তাহলে কথা বলতে আসছেন কেন? মেয়েদের রাস্তায় একা পেলেই কথা বলতে ইচ্ছে করে? পিছন থেকে ডাকতে ইচ্ছে করে?
রাগে আমার শরীর ঘিনঘিন করছে। এই বখাটে ক্ষ্যাতগুলোর যন্ত্রণায় রাস্তায়
বেড় হওয়া যায় না। মেয়ে দেখলেই হারামিগুলো ঝাপিয়ে পরতে চায়। টেনে
হেছড়ে খেতে চায়।
---আসলে আপু আপনে যা ভাবছেন আমি ঐ রকম নই। আমার নাম সানি।
---আপনার নাম সানি! এটা বলতে এসেছেন? আর আপু আপু করছেন কেন? আমি আপনার কোন
জম্মের আপু? শুনুন আপনার মত ছেলেদের আমার খুব ভালো করে চেনা আছে।
---আসলে. . . . না মানে. . . আপু আপনাকে একটা চিরকুট দিতে এসেছি।
---আমাকে চিরকুট দিতে এসেছেন? কিসের চিরকুট?
ছেলেটি আমার সামনে দাড়ানো। মূখ থেকে সিগারেটের দুর্গন্ধ বেড়িয়ে আসছে।
এতো বাজে জিনিস মানুষ কিভাবে খায় আমি বুজতে পারি না।সানি আবার আমতা আমতা
করে বলছে--
---সরি, কিছু মনে করবেন না। দোকানে যারা বসে আছে তারা আমার ফ্রেন্ড। ওদের
সাথে আমি বাজি ধরেছি। যদি আপনাকে আমি এই চিরকুটটি দিতে পারি তাহলে তারা
আমাকে কে এফ সি তে খাওয়াবে। প্লিজ আপু অন্য কিছু মনে করবেন না।
ছেলের সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি! চিরকুটের দিকে তাকাতেই লিখাটি চোখে পরলো।
ওখানে লিখা "I LOVE YOU"। রাগে আমার মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে গেছে। ঠাস করে
গালে একটা থাপ্পড় দিয়ে বললাম--
---বদমায়েশি করার আর জায়গা পাননা? মেয়ে দেখলেই চিরকুট দিতে ইচ্ছে করে?
বাজি ধরতে ইচ্ছে করে? মেয়েদের আপনারা কি মনে করেন? বাজারের পণ্য না জুয়ার
দান?
সানি কোন কথা বলছে না। গালে হাত দিয়ে নিচের দিকে মুখ করে তাকিয়ে রয়েছে। প্রচন্ড অপমানিত হলে মানুষকে যেমন দেখায় ঠিক তেমন লাগছে।
---আপনাদের বংশ পরিচয় নিয়ে আমার সন্দেহ হচ্ছে। ভালো বংশের ছেলেরা তো
রাস্তায় দাড়িয়ে মেয়েদের ট্রিকস্ করে না! লজ্জা থাকলে ফের যেন এখানে না
দেখি। আর বাজি ধরতে চাইলে আপনার ফ্যামিলির কাউকে নিয়ে ধরুন। রাস্তায় এসে
নিজের বংশ পরিচয় দেখাবেন না।
এই ক্ষ্যাতটার সামনে আমার আর দাড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে না। কথা বলতেও ঘৃণা করছে।
আমি আর দাড়ালাম না। পাশেই একটা খালি রিক্সা পেয়ে উঠে পরলাম।
* * * * * * * * * * * * * * * * * * * *
মাঝে মাঝে আমি আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই অবাক হই। মনে মনে বলি কিরে
প্রতিভা তোকে এতো সুন্দর লাগছে কেন? আজ আমার সেরকম কিছু একটা বলতে ইচ্ছে
করছে। ইচ্ছে করছে অনেক্ষন ধরে ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাড়িয়ে নিজেকে দেখি।
হাসলে কেমন লাগে দেখি, কাঁদলে কেমন লাগে কিংবা অভিমান করলে কেমন লাগে দেখি।
কিন্তু বেশিক্ষন নিজেকে দেখতে পারছি না। সময় নেই। কলেজের ফাউন্ডেশন ডে
উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। দুপুর দুটার মধ্যে যাওয়ার কথা। এখন বাজে
তিনটা। অনেক দেরি করে ফেলেছি। তবু নিজেকে ড্রেসিংটেবিলের সামনে রেখে
কয়েকবার দেখে নিয়েছি।
আজ শাড়ি পরেছি। নীল শাড়ি। কপালে লাল টিপ। দেখতে অনেক সুন্দর লাগছে। যেদিন বেশি সুন্দর লাগে সেদিন বেশি বেশি করে দেখতে ইচ্ছে করে।
--- আপু তুমি এখনো যাওনি? আর কতো সাজো? এমনিতেই তোমাকে অনেক সুন্দর লাগে। এতো সাজতে হবে না।
আমাকে ড্রেসিংটেবিলের সামনে দেখলেই পূর্ণতার মেজাজ গরম হয়। ছোট বোনটি কেন আমার সাজা দেখতে পারে না বুঝিনা।
---এইতো যাচ্ছি। তুই যাবি আমার সাথে?
---না।আমার যাওয়া লাগবে না। তুমিই যাও। তোমার সাথে গেলে আমাকে কুৎসিত লাগে।
পূর্ণতা দেখতে অনেক সুন্দর। তবু কেন আমাকে এতো হিংসা করে বুঝি না।
---তুই সবসময় আমাকে এতো হিংসে করিস কেন বলতো? আমি কি তোকে কখনো সাজতে নিষেধ করছি?
---ওমা! আমি তোমাকে কখন হিংসে করলাম? তোমাকে সুন্দর লাগছে বলছি বলে হিংসে
করা হয়? ঠিক আছে তুমি সাজো। সাজতে সাজতে পেত্নী হও। আমি গেলাম।
পূর্ণতা রাগ দেখিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেছে। মেয়েটাকে একটা কথা বলা যায়
না। অমনি রাগ করে। রাগ যেন সবসময় ঠোঁটের কিনারায় এসে থাকে।
বাসা থেকে বেড়িয়ে রিক্সা পেয়ে গেছি। রিক্সার জন্য দাড়িয়ে থাকা অসহ্য
লাগে। আজ তেমন লাগছে না। অবশ্য একা একা যেতে ভালো লাগছে না। পূর্ণতা সাথে
থাকলে ভালো হতো। দুজনে গল্প করে যেতে পারতাম।
রিক্সা ছুটে চলেছে। বিকেলের স্নিগ্ধ আলো হালকা বাতাসে মিশ্রিত হয়ে গায়ে
জড়িয়ে যাচ্ছে। মোড়ের টং দোকানটার কাছে এসে আগের মতো এখন আর মেজাজ গরম
হয়না। বদমাইশ ছেলেগুলোকে গত এক সপ্তাহ দরে কলেজ যাবার সময় দেখিনা।
একদিনেই জন্মের মতো শিক্ষা হয়ে গেছে। কেউ প্রতিবাদ করে না বলে ওরা মাথায়
উঠে। দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে নিজেদের নোংরামি প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
আজ কলেজ অনেক সুন্দর করে সাজিয়েছে। মেইন গেইট থেকে শুরু করে পুরো
ক্যাম্পাসে লাল নীল তারা বাতি লাগিয়েছে। চারদিকে নতুন নতুন ফুলের টব
বসানো। অনেক ছেলেমেয়ে পারফর্ম করবে বলে বাহারি রংয়ের ও ডিজাইনের পোশাক
পরে এসেছে। মুখে কড়া মেকাপ। দেখতে অদ্ভুত মনে হচ্ছে।
মাঠের একপাশে বিশাল মঞ্চ তৈরী করা হয়েছে। যেখানে এইমাত্র একটি ছেলে ও একটি
মেয়ে চমৎকার নিত্য উপহার দিয়েছে। দেখতে খুব মজা লাগছে। এখন একটি ছেলে
এসেছে গান গাইতে। বাড়ি মিষ্টি গলা।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বাসায় ফিরতে হবে। সন্ধ্যার পরে বাহিরে থাকলে আম্মু
ভিশন টেনশন করে। কখনো সন্ধ্যার পরে একা বাহিরে থাকতে পারি না। রাত করে
বাসার ফিরলে অনেক বকা খেতে হয়। আমার সাথে আমার দুই ক্লাসমেট। নীলা ও শিখা।
মাঝে মাঝে ওদেরকে দেখে আমার প্রচন্ড হিংসে হয়। ওরা যেখানে খুশি সেখানেই
যেতে পারে। যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। রাত দশটার পর বাসায় ফিরলেও কেউ কিছু
বলে না।
মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় ওদের মতো হই। মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়ে বেড়াই। কিন্তু
পারিনা। আমার মেন্টালিটি আমাকে বাধা দেয়। আমার সোসাইটি আমাকে বাধা দেয়।
বিকেল থেকে বসে আছি। অনুষ্ঠান ছেড়ে একটুও উঠতে ইচ্ছে করছে না। প্রত্যেকের
প্রেজেন্টেশনই অনেক ভালো লাগছে। কিন্তু আর থাকতে পারছি না। সন্ধ্যা
পেরিয়েছে অনেক্ষন আগে।
---নীলা-শিখা আমি যাইরে। আর থাকতে পারছি না।
---এখনই চলে যাবি? আর একটু থাক।
---নারে আম্মু অনেক টেনশন করবে।
ইচ্ছে থাকা সত্যেও আমি প্রগ্রামে থাকতে পারছি না। নীলা-শিখার কাছ থেকে
বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে এলাম। বাহিরে আধো আলো আধো ছায়া। আকাশে মধ্য বয়সি
চাঁদ জোছনা ছড়িয়ে যাচ্ছে। শেষ কবে একা একা জোছনা রাতে রিক্সা করে বাসায়
ফিরেছি মনে নেই। ভাবতেই ভালো লাগছে।
রাস্তা মনে হচ্ছে জনমানব শুন্য। কোথাও কেউ নেই অবস্থা। ইদানিং কি যে হলো
সন্ধ্যার পরে কেউ ঘর থেকে বের হয়না। সবার মাঝে আতংক বিরাজ করে। কি হয় কি
হয় অবস্থা। কখন কোথায় আগুন দিচ্ছে বোমা মারছে বলা যায়না। আমাদের এই
মানুষ মারার রাজনীতি কবে যে বন্ধ হবে আল্লাহ জানে। হঠাৎ হঠাৎ অবশ্য
রাস্তায় দুই-এক জনকে দেখা যাচ্ছে। দেখে মনে হয় খুব জরুরী কাজে বের
হয়েছে।
মোড়ের টং দোকানটার বেতরে দোকানি ছেলেটা বসে আছে। আশপাশে কেউ নেই। দেখে মনে হচ্ছে নিঃসঙ্গ কোন একটি গ্রহে একটি প্রাণীর বাস।
দূর থেকে আলো ফেলে একটি মটরসাইকেল ছুটে আসছে। হেড লাইটের আপার পজিশন দিয়ে
আলো আসছে। সম্পূর্ণ আলো আমার এবং রিক্সা ওয়ালার চোখে পরেছে। পিছনে কিছুই
দেখা যাচ্ছে না। কাছে এসেই হুড়মুড় করে বাইকের পিছন থেকে দুটি লোক নেমে
এসে রিক্সার দুই দিক থেকে আমাকে ঘিয়ে ধরেছে। আতংকে, ভয়ে আমি সজোরে চিৎকার
দিয়ে উঠেছি। রিক্সা ওয়ালা রিক্সা ফেলে ভয়ে পালিয়েছে। একজন আমাকে
রিক্সা থেকে হেছকা টান দিয়ে নামিয়ে নাক মুখ একহাতে চেপে ধরেছে যেন মনে
হচ্ছে শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যাবো। অন্য হাতে একটি চাকু পেটের কাছে
এমন ভাবে চেপে ধরেছে যেন অর্ধেকটা পেটে ডুকে গেছে। ভয়ে যন্ত্রণায় আমার
সারা শরীর থর থর করে কাপছে। একটুও নড়তে পারছি না। আমাকে ধরে রাখা লোকটা
কন্ঠকে ভয়ংকর করে বললো--
---চিৎকার করবি তো জানে মেরে ফেলবো।
আমি চিৎকার করতে পারছি না। নড়াচড়া করতে পারছি না। অন্য লোকটা আমার গলার
সোনার চেইন, কানের দোল খুলতে লাগলো। ভয়ে আতংকে আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম।
হঠাৎ ধুম করে একটা শব্দ হওয়ার সাথে সাথে আমাকে ধরে রাখা লোকটা "আহহ" করে
চিৎকার দিয়ে আমাকে ছেড়ে দুহাতে মাথায় হাত চেপে ধরেছে। কিছু বুঝে উঠার
আগেই কোথা থেকে ছুটে আসা ছেলেটি অন্য জনের নাক বড়াবড় হাতে রাখা ইট দিয়ে
মেরেছে। আমি অনুভব করলাম আমার নাকে মুখে হালকা গরম তরল এসে পরেছে।
মুহুর্তের মাঝে কি হলো বুঝতে পারছি না। সবকিছু কেমন সিনেম্যাটিক লাগছে।
বাইকে বসে থাকা অপর ছিনতাইকারী মনে হয় প্রচন্ড ভয় পেয়েছে। তাড়াতাড়ি
পালাতে চাইলো। বাইক স্টার্ট দেয়ার সাথে সাথে হেড লাইটে আলো এসে পরেছে
আমাদের গায়ে। আগন্তুক ছেলেটিকে চেনা গেলো। সানি। আমাকে চিরকুট দিয়ে
থাপ্পড় খাওয়া সানি। আঘাত পাওয়া লোক দুটি বাইকের কাছে ছুটে গেলে।
আমি মুর্তির মতো দাড়িয়ে রয়েছি। কিছুই বলতে পারছি না।
মনে হয় সানি আঘাত পেয়েছে। বাম হাতের কব্জির উপর থেকে রক্ত পরছে। ওর সেই দিকে কোন খেয়াল নেই। বুঝা যাচ্ছে আমাকে দেখে সে হতভম্ব।
---আপনার মনে হয়ে কব্জির উপরে কেটে গেছে।
আমি আস্তে আস্তে সানিকে বললাম। সানি ক্ষত হাতটি অপর হাত দিয়ে টেনে দেখছে।
মনে হচ্ছে অনেকখানি কেটে গেছে। আমি কাছে গিয়ে দাড়ালাম। কাটা স্থানের
রক্তে পরনের সাদা টি শার্টের অনেকটা ভিজে গেছে। হাত দিয়ে দেখতে চাইলাম
কতোটুক কেটেছে।
---এ কিছু না। আপনার কিছু হয়নি তো?
আমি ওর রক্ত ভেজা বাহু স্পর্শ করতে করতে বললাম--
---না আমার কিছু হয়নি। আপনার অনেকটা কেটে গেছে আসুন কিছু দিয়ে বেধে দেই।
---লাগবেনা। এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। চলুন আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি। আর আপনার মুখে মনে হয় রক্ত লেগেছে, ওটা মুছে নিন।
আমি কিছু বলতে পারলাম না। সেদিনের থাপ্পড় খেয়ে লজ্জায় মাথা নিচু করে রাখা মুখটি চোখের সামনে বেশে উঠলো।
আমি সানির পিছন পিছন হাটছি। লজ্জায় অনুশোচনায় আমি কোন কথা বলতে পারছি না। নিজেকে আমার প্রচন্ড ঘৃণা করতে ইচ্ছে করছে।
* * * * * * * * * * * * * * * * * * *
দুইদিন ধরে বাসা থেকে বের হতে পারছি না। কলেজ বন্ধ ছিলো। সেই ঘটনার পর থেকে
আম্মুর কড়া নির্দেশ কলেজ ছাড়া বাসার বাহিরে যাওয়া যাবে না।
আজ কলেজ খুলেছে। আম্মুকে বলে কলেজে যাবার জন্য বাসা থেকে বেড়িয়ে এলাম।
আসতে দিতে চায়নি। আরো কয়েক দিন বাসায় রেস্ট নিতে বলেছে। আমি শুনিনি।
রাস্তার একপাশ ধরে হাটছি। আমাকে সানির সাথে দেখা করতেই হবে। সেই দিন
লজ্জায় সরি টাও বলতে পারিনি। নিজেকে প্রচন্ড ঘৃণা করতে ইচ্ছে করছে। সানির
সাথে বাজে ব্যাবহারের জন্য প্রত্যেকটি মুহুর্ত আমার সত্তা আমাকে কুড়ে
কুড়ে খাচ্ছে। আমাকে একটি বারের জন্যও শান্তি দিচ্ছে না সানির করুণ অপমানিত
মুখ। চোখের সামনে বারবার বেসে আসছে হাতে ধরা চিরকুটের লিখা "I LOVE YOU"।
প্রত্যেকটি মুহুর্ত ইচ্ছে করছে চিরকুটটি নিয়ে মায়ার পরশ ভোলাতে।
ভালবাসায় বুকের আলিংগনে জড়াতে।
মোড়ের টং দোকানটার কাছে এসে চার দিকে চোখ ভুলিয়ে দেখছি। কোথাও সানির দেখা
নেই। থাকার কথাও নয়। তাকে আর টং দোকানটির দ্বারে কাছে দেখিনা। আমি
তীর্থের কাকের মতো এদিক সেদিন খুজছি। যদি পাওয়া যায় সেই আশায়।
---আফা আমি আপনারে খুছতেছি।
টং দোকানের ছেলেটি শব্দ করে বললো। আমি ছেলেটির কাছে গেলাম আগ্রহ নিয়ে কিছু একটা শোনার জন্য।
---আফা সানি ভাই আপনেরে এই খামটি দিছে।
আমি খামটি হাতে নিলাম। নিজেকে কেমন জানি শুণ্য মনে হচ্ছে। খামের ভেতরের একটি নীল রংয়ের চিঠিটি।
প্রতিভা,
প্রতিজ্ঞা করেছিলাম জীবনে আর কখনো কাউকে কিছু লিখাবো না। তবু সেই আপনাকে লিখতে হচ্ছে। সেই জন্যে সরি।
আমি আমার বাবা মার একমাত্র সন্তান। ভালো ছাত্র ছিলাম। ছোট বেলা থেকেই আমার
স্বপ্ন ছিলো জীবনে অন্যরকম কিছু একটা করবো। সবার চেয়ে আলাদা। সেই ইচ্ছে কে
মুঠোয় আনার জন্য চেষ্টার কোন ত্রুটি ছিলো না। কিন্তু আমি পারিনি। আমার
ফ্যামিলি আমাকে আমার স্বপ্ন পূরণ করতে দেইনি। আশ্চর্য হচ্ছেন? আশ্চর্য
হবার-ই কথা।
আমি হবার পর আব্বু আম্মুর দশ বছর চলে গেছে তাদের আর কোন সন্তান হয়নি।
আব্বুর অনেক আশা ছিল তাদের ফুটফুটে একটা মেয়ে থাকবে। যে কি না সারা বাড়ি
আলো করে রাখবে। কিন্তু তাদের আশা পূরণ হয়নি। এই নিয়ে আব্বু আম্মুর সাথে
প্রায়ই ঝগড়া হতো। আব্বু আম্মুকে পেইন দিতো তার প্রব্লেম বলে। আর আম্মু
আব্বুকে। মাঝে মাঝে এ নিয়ে প্রচন্ড ঝগড়া হতো দুজনের মাঝে। এমনকি আব্বু
আম্মুর গায়েও হাত তুলেতো।
দুজনের ঝগড়া দেখতে দেখতে আমি বড় হয়েছি। এটা আমি মানতে পারতাম না। আমার
অনেক খারাপ লাগতো। যার কারণে বাসার চেয়ে বাহিরেই বেশি ভালো লাগতো। বাহিরে
এসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে ভালো লাগতো। হইহল্লো করে সময় কাটাতে ভালো
লাগতো। বন্ধুদের পাল্লাই পরে সিগেরেট খেয়ে সবকিছু ভুলে থাকতাম। এসব করতে
করতে কখন যে সেই স্বপ্নবোনা ছেলেটি সমাজের বখাটে, অমানুষ, বদমাইশ হয়ে গেছে
নিজেই জানি না।
আপনাকে সেদিন চিরকুটটি দেয়ার পর নিজের প্রতি প্রচন্ড ঘৃণা জন্মেছিলো।
নিজেকে রাস্তার কুকুর মনে হচ্ছিলো। আপনাকে অনেক দিন ধরে দোকানে বসে দেখতাম।
অনেক ভালো লাগতো। অনেক স্বপ্ন দেখতাম আপনাকে নিয়ে। নিজের দিকে তাকিয়ে
আমার স্বপ্নকে প্রত্যেকবার খেলা ঘরে মতো ভেঙ্গে দিয়েছি। সত্যি কথা কি
জানেন সেদিন শুধু বাজিতে জেতার জন্য চিরকুটটি আপনাকে দিতে চাইনি। আমি
চেয়েছিলাম অন্তত বাজির মাধ্যমে হলেও আমার মনের লিখাটি আপনাকে দেখায়।
হয়তো মিছেমিছি ছিলো। তবুওতো বলতে পেরেছি।
গতকাল আব্বু আম্মুর সাথে প্রচন্ড ঝগড়া হয় এবং তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে
যায়। আমি আম্মুকে নিয়ে চলে যাচ্ছি দূরে কোথাও। যেখানে আব্বুর মতো মানুষ
থাকবে না। চেষ্টা করবো আম্মুকে অনেক অনেক সুখি রাখতে। জানি আব্বু ছাড়া এটা
কখনো সম্ভব না। যতই ঝগড়া করুন না কেন আম্মুতো আব্বুকে প্রচন্ড ভালোবাসতো।
আর কখনো আপনার সাথে আমার দেখা হবে না। একদিকে ভালোই হয়েছে। অন্তত একজন
বখাটে, বদমাইশ আপনার এলাকায় কমেছে। আমার কি মনে হয় জানেন সমাজের
প্রত্যেকটি বখাটে বা খারাপ ছেলেদের পেছনে এমন কিছু একটা আছে। হয়তো আমার
মতো নয় অন্যরকম।