বুধবার, ২ জুলাই, ২০১৪

আবেগপ্রবন ভালবাসার গল্প
লিংকটা কপি করেই মেয়েটাকে মেসেজ
করলো অপু।
-কংগ্রেচুলেশন! আপনার এই
লেখাটা পেজে দেয়া হয়েছে!
-ধন্যবাদ। ওটার কথা আমি প্রায় ভুলেই
গিয়েছিলাম!
-আচ্ছা, জীবনের প্রতি খুব
অনীহা মনে হচ্ছে! কেন?
-কারণ ওটা আমাকে কিছুই
দিতে পারেনি।
-নিজে বোধহয় নিতে পারেননি! এখন
ব্যর্থতা ঢাকতে জীবনের দোষ!
-
ছোট্ট কনভার্সেশনটা এখানেই
থেমে গেলো। সিন করার
সময়টা দেখে আরো একবার বিরক্ত
হলো অপু। ১৫ মিনিট হলো কোন সাড়াশব্দ
নাই!
'বিচ্ছিন্ন
ঘটনা হিসেবে ব্যপারটা ভুলে যাওয়া যায়
' ল্যাপটপটা বন্ধ
করতে করতে ভাবলো "আমি স্বপ্ন"
আইডির মালিক।
***
ভুলে যেতে চাইলেও পরদিন
সকালটা অপুকে মনে করিয়ে দিলো সেই
বিচ্ছিন্ন ঘটনার শেষ থেকে।
ইনবক্স চেক করতেই
চোখে পড়লো মেসেজটা।
-ব্যর্থতা ঢাকতে পারলাম না। তাই
চলে যাচ্ছি। কালকের সকালটা নাকি খুব
দামী! ওটা দেখে যাবো। সাদা কাগজ
গুলোই আমার সুইসাইড নোট। অকারণেই
চলে যাচ্ছি কিনা!
সস্তা রসিকতা মেশানো সিরিয়াস
ধরনের মেসেজটা অপু তিনবার পড়লো।
পাঠানোর সময়টা মধ্যরাত।
মধ্যরাতে জেগে থাকা সব মানুষের
ভিতরেই কিছুটা পাগলামো কাজ করে।
মেয়েটা মানষিক সমস্যায় ভুগছে।
রিপ্লাই দেয়ার বক্সটা উপস্থিত। কিন্তু
কালো হয়ে আছে "রহস্যময়ী বাচাল
কাব্য" নামটা।
ঝাড়া আধঘণ্টা ওভাবে বসেই
চিন্তা করলো ছেলেটা।
***
সাইকোলজিক্যাল ব্যপার স্যাপার
নিয়ে কোন আগ্রহ নেই ওর। কিন্তু এই
মেয়ের ব্যাপারটা কেন যেন খুব টানছে।
সিদ্ধান্ত স্থির করেই গুগল
ম্যাপে ঢুকলো অপু। ঢাকা থেকে যশোর
কোর্ট স্টেশনের ডিসট্যান্স দেখলো।
এরপর ট্রেনের খোঁজ। দুপুর দুইটায়
বসুধা এক্সপ্রেস।
লোকেশন খোঁজার ব্যপারে সম্পূর্ণ
রূপে সাহায্য করলো অপুর অন্ধকারে ঢিল
ছোড়ার প্রবনতা আর পেজে পোস্ট
হওয়া "রহস্যময়ী বাচাল কাব্য"র সেই
গল্পটা।
***
পনের মিনিট লেট করে ছাড়লো ট্রেন। অপু
নিজের উপর বেশ বিরক্ত। সিদ্ধান্তটা খুব
খামখেয়ালি হয়ে যাচ্ছে।
প্রথমতঃ মেয়েটার কোন
ঠিকানা বলতে কিছুই নেই! দ্বিতীয়ত ও
আত্মহত্যা করবে কিনা তারও তো কোন
ঠিক নেই! শুধু মাত্র
একটা গল্পকে পুঁজি করে এই গাধামি করার
কোন মানে হয়!!
অপু তবুও আশায় বুক বাঁধে। গাধাদের
বুকে কোন আশা থাকেনা।
***
রাত সাড়ে দশটায় ট্রেন কোর্ট
স্টেশনে এসে পৌঁছলো।
আড়মোড়া ভাঙলো অপু।
পকেটে ভাইব্রেশন হচ্ছে মোবাইলটা,
আম্মার ফোন।
"ভালো আছি ..হ্যাঁ হ্যাঁ রুমেই ..."
মেসে থাকায় বেশ সুবিধা। আম্মা খুব
একটা দুশ্চিন্তা করেনা!
***
একে তো রাতের বেলা। তার উপর শীত।
মেয়েটা গরমের
সময়টা বেছে নিতে পারতো!
অথবা বর্ষাকাল।
ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে রেললাইনের উপর
দাড়িয়ে থাকতো, ট্রেনের হুইসেল
শোনা মাত্রই কেঁপে উঠতো খানিকটা,
ভয়ে অথবা ঠান্ডায়! বৃষ্টির আদর
পেতে আরো কয়েকটা দিন
বেঁচে থাকতে চাইতো!
ধুর! কি সব হাবিজাবি ভাবছি। অপু যেন
নিজেকেই নিজে বললো!
"মামা ,এক কাপ চা দেন তো।" রুটিটায়
ছোট্ট কামড় বসিয়ে অর্ডার দিলো সে।
***
ঘন্টার কাঁটা এগারোকে ছুঁয়ে দিচ্ছে। আর
মাত্র পনেরো মিনিট বাকি। দোকানপাট
খোলা নেই বললেই চলে। আরো এক কাপ
চায়ের অর্ডার
দিয়ে রুটি চিবাতে লাগলো অপু। শীতের
রাতটা কিভাবে কাটবে বুঝতে পারছে না।
ভোর হতে এখনো ঘন্টা ছয়েক বাকি।
"ভাইজান, কই থেকে আসছেন ? যাইবেন
কই? "গ্রাম্য গভীর রাতের কাস্টমারের
উদ্দেশ্যে দোকানদারের প্রশ্ন।
"ঢাকা থেকে আসলাম। । ঘুরতে আসছি! "
"এতো রাত্রি বেলা! ঘুরতে আইছেন!
আচ্ছা যাইবেন কই? " কৌতুহল
বাড়লো দোকানির।
"কই যাবো মানে! ঘুরবো ...আশেপাশেই
ঘুরবো। সকালে চলে যাবো!"
সন্তোষজনক উত্তর খুঁজে না পাওয়ায়
অস্বস্তিবোধ করছে অপু।
"ঢাকা থেকে আসছেন! অথচ কই যাবেন
জানেন না! "
দোকানদার যেন খুব অবাক হলো। গ্রাম-
গঞ্জের লোকেরা অল্পতেই অবাক হয়।
তখন তাদের চোখের
দিকে তাকালে মজা পাওয়া যায়। অপু
মজা পাচ্ছে না। বিরক্ত হচ্ছে!
"এতকিছু জিজ্ঞেস করছেন কেন?
সমস্যা কি? " চায়ের কাপটা ঠাস
করে ট্রে তে রেখে দাড়িয়ে পড়লো অপু।
টাকা দিয়েই হনহন
করে হাঁটা ধরলো একদিকে। এই বাচাল
দোকানির হাত থেকে রক্ষা পেতে হবে।
কিছু দূর যেতেই খেয়াল হলো ওর,
'রাতটা কাটাবো কোথায়?'
আশপাশে চোখ বুলাতেই বোঝা গেলো,
একমাত্র ভরসা এখন বাচাল দোকানদার!
"ভাইজান ফিরা আসলেন যে!"
দেঁতো হাসিতে অদ্ভুত
লাগছে লোকটাকে! রাগ
চাপিয়ে হাসলো অপু।
"সরি ভাই!
আসলে রাতটা কোনমতে কাটানো দরকার।
সকালেই চলে ....."
"বুচ্ছি ভাই! বসেন। আপনি আমার
বাসাতেই থাকবেন। যদি আপনার
আপত্তি না থাকে।" দোকানির
কন্ঠে আন্তরিকতার ছোঁয়া।
"আপত্তি নাই! কিন্তু আপনি থাকেন
কোথায়? " অপু জিজ্ঞেস করলো।
ওর প্রশ্নের উত্তরে দোকানদার, দুই
হাতে ভর
দিয়ে নিজেকে খানিকটা পিছিয়ে নিলো।
দক্ষ হাতে সুন্দর
করে বিছিয়ে দিলো রোল
করা কাঁথা গুলো। ছোট্ট দোকানটা যেন
হয়ে গেলো সাধারণ একটা বিছানা!
এতক্ষণে অপু খেয়াল করলো, লোকটার
একটা পা নেই!
***
"ভাইজান, রেডি!
জুতাটা খুইলা আইসা পড়েন। "
অপু কিছুটা ঘোরের মধ্যে পড়ে গেল।
একে তো অপরিচিত জায়গা তার উপর
অপরিচিত মানুষের সাথে দোকানের
ভিতর রাত্রি যাপন! বিসমিল্লাহ বলে ও
দোকানে ঢুকতেই ঝাপিটা ভিতর
থেকে ফেলে দিলো দোকান ঘরের
মালিক।
"ভাইজানের নামটা? "
"অপু। মোহাম্মদ অপু। আপনি? "
"আমার নাম রঞ্জু। নেন কলা রুটি খান। "
"না, না! আমি কিছু খাবো না। "
অসম্মতি জানায় অপু।
"আরে ধরেন! এখন আপনি আমার মেহমান!
"
রঞ্জু মেহমানের সেবায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
আর অপুর অবাক হওয়ার
মাত্রা বাড়তে থাকে ধীরে ধীরে। কতই
না আন্তরিক এই মধ্য বয়সী গ্রাম্য
মানুষের দেঁতো হাসিটা।
সংকোচবোধ উপেক্ষা করেই
প্রশ্নটা করলো অপু,
"রঞ্জু ভাই! আপনার এই
অবস্থা হলো কিভাবে? "
"পায়ের কথা বলতিছেন? "
"জ্বী"
প্রশ্ন নিশ্চিত হয়ে খুব
করে একটা দীর্ঘঃশ্বাস ফেললো রঞ্জু।
এরপর শুরু করলো জীবনের গল্পের ছোট্ট
একটি অংশ।
***
রাত বাড়তে থাকলো।
বাড়তে থাকলো অপুর বিস্ময়।
অন্ধকার দোকানটায় যেন প্রজেক্টর
লাগানো হয়েছে! অপুর চোখের
সামনে হুটহাট করে ভেসে উঠছে সব,
"মেয়েটার নাম ছিলো সায়মা। পাশের
গ্রামেই বাড়ি। মাইয়াটার মা ওরে ছোট
রেখেই মইরা গেলো। কেউ কেউ
বলে সায়মার বাপই ওর
মা রে মাইরা ফেলছে! আসলে ওর
বাপটা ছিলো পিশাচ।
সায়মা তখন সবেমাত্র কলেজে।
আমি এইচএসসি ফেল দিয়া পড়ালেখা বাদ
দিছি। কলেজের কাছেই আমাদের
বাড়ি হওয়ায়
সায়মারে লুকায়া লুকায়া দেখতে খুব
সুবিধা হইতো আমার! মেয়েটা খুব
একটা ফর্সা ছিলো না। কিন্তু ওরে আমার
খুব ভালো লাগতো। সাহস করে গেছিলাম
অনেকদিন, কথা বলতে। কিন্তু
মাইয়াটা তেমন একটা পাত্তাই
দিতো না।
এইভাবে করে কেমনে কেমনে জানি বছর
ঘুইরা গেলো! একদিন সাহস
করে সরাসরি বইলা দিলাম যে,
আমি ওরে ভালোবাসি। উত্তরে কিছু
না বললেও মেয়েটা সেদিন কেমন যেন
খুশি হইয়া গেছিল! ওই শুরু হইলো আমাদের
ভালোবাসা। লুকায়া লুকায়া প্রেম করার
মধ্যে ব্যপক আনন্দ ছিল।
হঠাৎ একদিন সকালে কলেজ যাওয়ার
পথে সায়মা আমাকে বললো,
"রঞ্জু,
তুমি আমারে বিয়া কইরা ফালাও!"
আমি তখনও তেমন একটা কিছু
কইরা উঠতে পারি নাই। কি কারণে হঠাৎ
এই কথা, জিজ্ঞাসা করতেই ও
আমারে বললো,
'ওর আব্বা নাকি ইদানিং কেমন যেন
হয়ে যাইতেছে। পঞ্চাশ পঞ্চান্ন বছরের
বুড়া বাপ রাতে মদ খাইয়া আইসা মেয়ের
ঘরে ঢুকতে চায়! " ওর নাকি এইসব
ভাল্লাগতাছে না। আমি খুব চিন্তায়
পইড়া গেলাম।
ওরে সাবধানে থাকতে বইলা আমি কাজের
ধান্দায় লাগলাম।
এর কয়েকদিন পর থেকে প্রায়
সপ্তাহখানেক
ধরে কলেজে আসে না সায়মা। শেষমেষ
আর না পাইড়া ওর বাড়িতে গেলাম খোঁজ
নিতে। গিয়া দেখি জ্বরে মেয়েটার
গা পুইড়া যাইতেছে! অথচ ওর বাপের কোন
খোঁজ নাই! আমারে দেইখাই
সায়মা হাউমাউ
কইরা কাইন্দা দিয়া কইলো ,
'রঞ্জু তুমি পারলা না! রঞ্জু
তুমি পারলা না। "
ওর অবস্থা দেইখা আমি বুইঝা গেলাম,
খারাপ কিছু একটা হইছে। অনেক
জিগাইলাম, কি হইছে! কি হইছে! কিন্তু ও
আমারে কিছুই কইলো না। শুধু বুকের ভিতর
আইসা হড়হড় করে বমি কইরা দিলো। নিজ
হাতে ওরে সেদিন পরিস্কার
করে দিলাম।
মুচকি মুচকি হেসে পাগলীটা আমার চোখ
মুছে দিতেছিলো! আসার সময়
বলে আসছিলাম, "যেকোন সময়
কাজী অফিসে যাওয়া লাগতে পারে।
তুমি রেডি থাকবা" সায়মা চোখের
ইশারায় বইলা দিলো, থাকবে। সন্ধ্যার
দিকেই সায়মারে নিয়া এক মোল্লার
কাছে গেলাম। ওর
আব্বা বাড়ি না থাকায় বেশ
সুবিধা হইছিলো। কয়েকটা দোস্ত
আমারে খুব সাহায্য করছিলো। কবুল বলার
সময় অসুস্থ মাইয়াটার মুখটা যেন জ্বলজ্বল
করতেছিলো!
এইটা জানা কথা যে, পরদিন সকালে সব
জানাজানি হইতো। এজন্য ওকে সেদিন
রাত্রেই চইলা আসতে বললাম। আমাদের
প্লান ছিলো ঢাকা চইলা যাবো।
সায়মা কথা দিলো, সে আসবে। কিন্তু ওর
চোখে ছিল রহস্য।
কয়েকজন বন্ধুরে নিয়া রাইত এগারোটার
ট্রেনের অপেক্ষায় ছিলাম।
সায়মাকে বলছিলাম মিনিট বিশেক
আগে আসতে। ও কথা রাখছিল। আসছিল
ঠিক আধাঘন্টা আগে। কিন্তু ঢাকায়
যাওয়ার জন্য না।
একেবারে চইলা যাওয়ার জন্য! "
"মানে কি! ক্লিয়ার করেন! " অস্থির অপু
দ্রুত তাগাদা দিলো। ঘটনার শেষটুকু
শুনতে টানটান উত্তেজনা ওর মধ্যে।
রঞ্জু আবার শুরু করলো,
"সাড়ে দশটার দিকে দূরপাল্লার
একটা সাদা ট্রেন যাইতেছিল এই স্টেশন
হয়ে। আমরা ওই
যাত্রী ছাউনিতে ছিলাম। ট্রেনের
বিরতিহীন হর্ণ
শুইনা আমরা সেদিকে তাকাইলাম,
দেখলাম একটা মানুষ
দাঁড়ায়া আছে রেললাইনের উপর। উজ্জ্বল
আলোতে আমার
চিনতে অসুবিধা হইলো না যে , এইটাই
আমার নতুন বউ। এইটাই আমার সায়মা। "
"তারপর?" অপুর কন্ঠে অধৈর্য একটা ভাব।
"তারপর আর কি! পাঁচ মিনিট হাঁটার
পথটাতে খুব জোরে দৌড়াইলাম। অল্পের
জন্য পৌঁছাইয়াও গেলাম। কিন্তু
পাগলীটার গায়ে সেদিন সেকি শক্তি।
পড়ে গেলাম আমিও। পা টা গেলো, তবুও
বেঁচে গেলাম। মরে গেলো আমার নতুন
বউটা। শালার ভাগ্য! বউটারে একটু আদরও
করতে পারলাম না।
ভাইজান! ঘুমাইলেন নাকি? "
অপু ঘুমায়নি।
ঘুমন্ত মানুষের চোখ বালিশ ভিজায় না।
সর্দি হলে মানুষ নাক টানে। অপু নাক
টানছে।
কষ্ট পেলে মানুষ কাঁদে।
কাঁদলে কিছুক্ষণের জন্য সর্দি লেগে যায়।
রঞ্জু বুঝে ফেললো, আগন্তুক
ছেলেটা এখনো ঘুমায়নি।
ঘুমন্ত মানুষ নাক টানে না।
***
ফজরের পর আর ঘুমালো না অপু।
আলো ফুটলেই আশেপাশে চোখ
রাখতে হবে। রাতের কথা মনে পড়তেই
জেগে উঠলো অপুর কৌতুহল।
"আচ্ছা, রঞ্জু ভাই! আপনি আর
বিয়ে করেননি? "
"নাহ্! বউ আমার একটাই ছিল।
মইরা গেছে! ব্যস " রঞ্জুর
কাঠখোট্টা জবাব।
"এত জায়গা থাকতে এরকম
একটা ফাঁকা জায়গায় দোকান দিলেন
কেন? ওইখানেও দিতে পারতেন! "
ছাউনির আশপাশের দোকান
গুলো দেখিয়ে, অপু বললো।
"এইখানে আমার বউয়ের স্মৃতি আছে।
আমার বিবাহিত জীবনের বয়স ১২। এই
দোকানটারও ঠিক তাই! বুচ্ছেন? "
"হুম বুঝলাম! "
রঞ্জুর গল্পে মগ্ন অপু কিছুক্ষণের জন্য
ভুলে গেলো আলো ফোঁটার কথা। ওর সব
মনোযোগ এখন চায়ের কাপে আর পুরাতন
সব স্মৃতির গল্পে।
***
শাড়ির কুঁচি ঠিকঠাক
করতে গিয়ে দেরি হয়ে গেলো।
শেষবারের মতো আর রঞ্জু ভাইয়ের
চা টা খাওয়া হলো না। চুপচাপ
বেড়িয়ে পরলো মেয়েটা। বাসার সবাই
অলস ঘুমে মগ্ন।
গোলাপী রংয়ের
শাড়ি পড়া মেয়েটাকে খুব
মিষ্টি মিষ্টি লাগছে। চেহারার
সাথে নামের এতো মিল
থাকতে পারে,এটা মিষ্টিকে না দেখলে বিশ্বাস
করা সম্ভব না।
মিষ্টি এখন রেললাইন ধরে হাটছে।
সাতটা পনেরতে ট্রেন যাবে। মিনিট
পাঁচেক দেরি হতে পারে। এখন
সাতটা বাজতে দুই মিনিট বাকি। গল্পের
মতোই হচ্ছে সব। এখন শুধু ট্রেনটা ঠিকঠাক
আসলেই হয়...।
আনমনা মিষ্টি কদম গুনতে গুনতে রঞ্জু
ভাইয়ের দোকানের দিকে চলে আসলো।
ট্রেনটাও আজ যেন একটু তাড়াতাড়িই
চলে আসছে!
***
রঞ্জুই আগে দেখলো মিষ্টিকে। আজ ওর
জন্য স্পেশাল চা হবে একটা, মেহমানের
উপলক্ষে। রঞ্জুর দেঁতো হাসির উৎসের
দিকে তাকাতেই অপুর খেয়াল হলো সব!
ট্রেনের তীক্ষ্ণ হুইসেল
হাসি মুছে দিলো রঞ্জুর মুখ থেকে।
মিষ্টি ওই দূরেই
দাঁড়িয়ে পরলো সাথে সাথে, মুখে তৃপ্তির
হাসি।
কনফিউশনে না ভুগে সাথে সাথে দৌড়
লাগালো অপু। দৈত্যটা বিকট
শব্দে এগিয়ে আসছে। মিষ্টি খুব মনোযোগ
দিয়ে দেখছিল ট্রেনটাকে। ওর
মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটালো অপুর
চিৎকার।
ছেলেটা নায়কদের মতো দৌড়াচ্ছে! এই!
এসেই তো পরলো! এক সেকেন্ডের জন্য
মিষ্টি পুরোপুরি ভুলে গেলো ওর উদ্দেশ্য।
ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু হলো ছেলেটার
অস্থির চেহারা।
এটাই অপুকে সাহায্য করলো। শেষ
পর্যায়ে এসে শূন্যে ঝাপিয়ে পড়ে মেয়েটাকে ধাক্কা দিলো সে।
পাথরে মাথা ঠুকে অজ্ঞান
হয়ে গেলো মিষ্টি। আর দুর্ভাগা অপুর
পরিণত হলো একজন রঞ্জুতে।
***
"মেয়েটাকে ঠেলে দিতেই আমি লাইনের
উপর আছড়ে পড়লাম। উঠতে গেলাম ,আর
দেখি শালার কনভার্সটা কিসে যেন
আটকে আছে। ব্যস....."
বন্ধু আজহারকে বলছিলো অপু।
"কিন্তু হাসপাতালে আইলো না কেন
মাইয়াটা? " আজহার রাগান্বিত!
"ওই শালা! পরদিনই তো চলে এলাম যশোর
থেকে! "
"ও আচ্ছা! তা ফেসবুকে এখন কি অবস্থা?"
আজহারের এমন প্রশ্নের উত্তর জানার
আগে পিছিয়ে যেতে হবে একটা বছর।
***
কাছ থেকে একবার
মৃত্যুকে দেখে ফেললে বেঁচে থাকাটা খুব
আনন্দের হয়ে যায়। মিষ্টির এই আনন্দের
মধ্যেও অপরাধবোধ কাজ করছে। সেদিন
জ্ঞান ফেরার পর অনেক
খোঁজা হয়েছে ছেলেটাকে। কল্পনায়
ভেসে থাকা চেহারা ছাড়া আর কোন ক্লু
না থাকায় পাওয়া গেল না তাকে। অথচ
প্রতিদিন কতশতই না কথা হয় তাদের!
পা কেটে ফেলার পরেও কষ্ট পায়নি অপু।
কারণ রহস্যময়ী বাচাল কাব্য আবার
ফিরে এসেছে। সেদিনের বেঁচে যাওয়ার
ঘটনা 'আমি স্বপ্ন' আইডির সাথে শেয়ার
করে মিষ্টি। ঠিক যেন মায়ের
কাছে মাসির গল্প!
আত্নহত্যার ব্যপারটা ওই
ছেলেটা কিভাবে জানলো! এই নিয়ে ওর
কৌতুহলের শেষ নেই। তবে কিছুতেই মুখ
খোলেনি অপু। ওর আত্মপ্রত্যয়ী মনোভাব
আর জীবনকে নতুন নতুন দৃষ্টিকোণ
থেকে দেখার
পরামর্শে মিষ্টি নিজেকে নতুন
ভাবে আবিস্কার করে। আর অনুভব করে ওই
অ্যানোনিমাস আইডির প্রতি প্রচন্ড টান।
কথায় কথায় একদিন জিজ্ঞেস করে অপু,
-আচ্ছা, ওই হিরোটার
প্রতি তুমি কি কৃতজ্ঞ?
-কৃতজ্ঞ না ছাই!
ব্যাটা আমাকে বাঁচিয়ে দিয়ে হারিয়ে গেলো!
জীবনের মানে তো তুমিই শিখালে।
তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ।
-ওই! ও
যদি তোমাকে না বাঁচাতো তাহলে আমি তোমাকে লেকচার
ঝাড়তাম কিভাবে? স্বার্থপর
হচ্ছো কিন্তু তুমি!
-তা অবশ্য ঠিক! কিন্তু ওর
ব্যপারে তোমার এতো কি? হ্যাঁ!
-ধুর! কিছু না। আচ্ছা ওই ছেলেটা তোমার
কাছে আসলে তুমি কি করবা?
আনমনা হয়ে যায় মিষ্টি। সেই অস্থির
চেহারা চোখে বৃষ্টি নামায়। লোকজন
বলেছে, ছেলেটার
একটা পা কেটে ফেলতে হয়েছে। বলদ
একটা। তবে সব ছেলেরাই একরকম হয় না।
পুরোনো প্রেমিকের কথা ভাবতেই
রেগে উঠে মিষ্টি!
অপুকে রিপ্লাইটা দিয়েই ল্যাপটপ বন্ধ
করে দেয় সে।
-থাপ্পড় দিবো একটা।
অপুর ঠোঁটে ঝুলে আছে মুচকি একটা হাসি।
***
ফেসবুকের অবস্থা থাপ্পড়েই শেষ হয়নি।
অপু থাপ্পড় খাওয়ার জন্য এক পায়ে খাড়া,
সঙ্গে স্ক্র্যাচ দুটো। এক বছর পর আবার
দেখা হচ্ছে ওদের। দুই ভাগ
হয়ে গেছে অপুর মন। একভাগে শুধুই
ভালোবাসা। আরেক ভাগে নিজের
অক্ষমতা আর বাস্তবতা মেনে নেয়ার
শক্তি।
***
গোলাপী রংয়ের
শাড়ি পড়া মেয়েটাকে খুব
মিষ্টি মিষ্টি লাগছে। চেহারার
সাথে নামের এতো মিল
থাকতে পারে,এটা মিষ্টিকে না দেখলে বিশ্বাস
করা সম্ভব না।
মেয়েটা আজও রেললাইন ধরে হাটছে।
স্বপ্ন গুলো বাঁচিয়ে দেয়া স্বপ্নবাজের
জন্য অপেক্ষা ...। উনি "স্বপ্ন"।
ট্রেনটা থেমে যাচ্ছে।
থেমে যাচ্ছে মিষ্টির হৃদস্পন্দন!
বেশি উত্তেজনায় ঘুম ঘুম লাগে মিষ্টির।
ঘুমের মধ্যেই নাকি স্বপ্নেরা আসে!
কই! ও তো আসছে না! রাগ
হতে লাগলো মিষ্টির। ফোন অফ!
ট্রেনটা আবারও যাত্রা শুরু করলো। শুধু
থেমে থাকলো যাত্রী ছাউনিতে বসে থাকা কান্নারত
মেয়েটা, আর তার কাঙ্খিত সেই স্বপ্ন!
***
উঠে দাঁড়াতে গিয়েই
চোখে পরলো ছেলেটাকে। স্ক্র্যাচে ভর
দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই ছেলেটা,
অস্থির একটা চেহারার মালিক। সেই
দৌড়ে আসা ছেলেটা একটুও বদলায়নি।
মনের রেললাইন ধরে কি জোরেই
না দৌড়াচ্ছে স্বপ্নটা! মিষ্টি বারবার
মুগ্ধ হয়।
"একটা বছর এভাবে কষ্ট দিলা কেন?"
গোল গোল চোখ দুটোতে যেন শ্রাবণ ঢল
নেমেছে।
"আমিও তো কম পাইনি! এছাড়াও
আমি তো এখন ......"
"তোমার গালটা আগাও। ডান গাল! "
অপুকে বাঁধা দিয়ে মিষ্টির হুকুম।
থাপ্পড়ের ওজন নিয়ে দুশ্চিন্তায়
ভুগছে অপু!
হালকা ওজনের থাপ্পড়ে বিস্ময়ে বিমূঢ়
হয়ে গেলো ছেলেটা। ঠোঁট দিয়ে এমন
থাপ্পড় শুধু অতৃপ্তি বাড়ায়। তবুও চুপচাপ
থাকাটাই বোধহয় শ্রেয়।
চুপ থাকার ফলাফল মিললো হাতেনাতে।
গোলাপী মিষ্টি স্বপ্নের
সাথে মিশে যেতে চাইছে। স্ক্র্যাচ
দুটো ফেলে দিলো অপু। ভালোবাসার
মানুষের উপর বিশ্বাস করা যায়।
বিশ্বাসের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে থাকার
জন্য স্ক্র্যাচের প্রয়োজন নেই।
***
দূর থেকে রঞ্জুর চোখ ওদের দুজনকে একজন
ভেবে ভুল করছে। তবে মন কখনো ভুল
করে না। এদিকেই আসছে ওরা।
ঝাপসা চোখে সব দেখতে পাচ্ছে রঞ্জু।
ঈর্ষাযুক্ত নোনা পানিতে গাল
ভিজে যাচ্ছে তার। নাহ্!
বয়সটাকে নিয়ে আর পারা গেলো না।
চোখের সাথে মনটাও খারাপ হয়ে যাচ্ছে!
কাপ রেডি করলো রঞ্জু। স্পেশাল দু কাপ
চা হবে আজ। খুব স্পেশাল।
ওরা এসে পড়েছে।
সস্তা অনুভূতি মেশানো চায়ের
কাপে গভীর চুমুক দিয়ে তৃপ্ত একটি জুটি।
আর পুরাতন সেই প্রেমিক বারবার চোখের
সমস্যায় জর্জরিত।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন